মনে তো অনেক স্বপ্ন আসে কিন্তু স্বপ্নরা ডানা মেলে কিছুটা সময় আর ভাগ্যের খেয়ালে। তবে এটাও সত্যি যে "ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় ". যেহেতু তারিখ নির্দিষ্ট তাই আগের থেকেই প্ল্যান করতে কোনো অসুবিধে থাকে না। মাসখানেক আগেই টিকিট কেটে সব বুকিং করে ফেললাম সহজেই। এইবার শুধু সব বাধা-বিঘ্ন কাটিয়ে অপেক্ষা। যত দিন এগিয়ে আসছে ততো মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছেগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। কল্পনার ডানায় উড়ান জমিয়েছি আমরা। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে অচেনাকে চেনা অজানাকে জানা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু মাঝে মাঝে কল্পনার আকাশে কালো মেঘের বাঁধ সাধছে শ্রাবনের ঘনঘটা। আমাদের বিয়ে হয়েছিল শ্রাবনের ভরা বর্ষায় দ্বিতীয় সোমবার , আর এবছর ও ১১ ই শ্রাবন সোমবার। বর্ষায় পাহাড় ভয়ানক। সবদিক খেয়াল রাখতে হয় , দিন দিন হিমালয় যেভাবে ধংসলীলায় মেতে উঠেছে তাতেকরে সুস্থ ভাবে বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরাটাই যেখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ , সেখানে উত্তরাখণ্ডের ওই দুর্গম এলাকায় অবস্থিত ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দিরে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানোটাই সবথেকে বড় প্রাপ্তি। হাতে ছুটি মাত্র ৩ দিন।
শুক্রবার অফিস করে দুপুর ৩টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ঝাড়গ্রাম থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে। হাইওয়ে জ্যাম কাটিয়ে কোনোরকমে দৌড়ঝাঁপ করে শেষ মুহূর্তে আমার পোছালাম কলকাতা এয়ারপোর্ট। ফ্লাইট ছিল রাত ১২ টা নাগাদ। এয়ারলাইন্স আবার পাকামো করে ফ্লাইট টাইম এগিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় ৮:৩০ করে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো ফ্লাইট মিস করিনি যদিও সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ ছিল।
দিল্লি এয়ারপোর্ট এ নামলাম রাত ১২;৩০ নাগাদ , টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি বুকিং করলাম একদম ডেস্টিনেশন পর্যন্ত। ভাড়া আকাশছোঁয়া বললেও দরকষাকষি করে একটা উপযুক্ত ভাড়া ঠিক করে ঝাঁকিয়ে বসলাম আমরা দুজন। সারা রাতের যাত্রা তাই একটু আরাম করে গাড়িতেই বিশ্রাম নিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দিল্লি হ্বরীদ্বার হাইওয়ের বুক চিরে সারারাত ছুতে চললো আমাদের গাড়ি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধাবায় একটু করে দাঁড়িয়ে চা পর্ব যাতে ড্রাইভার এর ঘুম না পেয়ে যাই। ড্রাইভের মানুষটিও মধ্যবস্ক বেশ দিল খোলা দিল্লিবাসী , ও মিষ্টিভাষী। উনিও কোনোদিন যাননি অতদূর। আবার যখন জানলাম যে পাহাড়ে চালানোর অভিজ্ঞতা একদমই ওনার নেই , শুনেই তো শ্রেয়সী ভ্রু কোঁচকালো। আমি অভয় দিলাম ডোন্ট worry , Mai Hun Nah ..... ড্রাইভার কেও আস্বস্ত্য করলাম , বললাম অসুবিধে হলে আমাকে দিও।
ভোরবেলায় পোছালাম হরিদ্বার , যেতে যেতে দেখলাম গঙ্গায় বিরাট ভিড় ভোলে ভক্ত-দের। শ্রাবন মাস বলে কথা।
আজ শনিবার, ২৬ ই জুলাই ২০২৫। সকাল ৯টা নাগাদ পৌঁছালাম ঋষিকেশ। বর্ষায় গঙ্গা প্রবল দুর্নিবার গতিতে বয়ে চলেছে। দেখলেই শিউরে উঠতে হয়। জানালার পাশে মা গঙ্গার প্রবল বিশাল রূপ দেখতে দেখতে ভাবছি ল্যান্ড স্লাইড বা পাথর পড়া এইগুলো যেন আমাদের যাত্রার পথের বাধা না হয় এই মনো কামনা নিয়ে ক্রমশ এগোচ্ছি। বেলা ১২ টা নাগাদ আমরা পৌছালাম দেবপ্রয়াগ সঙ্গম। এখানে গঙ্গা নদী আর অলকানন্দা নদীর মিলন স্থল। হিন্দু ধর্মমতে পঞ্চ প্রয়াগ সঙ্গমের ইটা একটা প্রয়াগ। এখান থেকেই গঙ্গার মূল স্রোতের সূচনা। তাই একদম দেরি না করেই ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে নদীগর্ভে প্রবেশ করলাম আমরা এবং জল স্পর্শের মাধমে অদৃশ্য খাতায় কিছুটা পূর্ণ্য সংগ্রহ করলাম। এই জায়গাটার তেজ এমনই আকর্ষণীয় যে ছেড়ে যেতে মন না চাইলেও , সময় বড়ো বালাই। ... তাই আবার গাড়িতে উঠে বসলাম আর ড্রাইভার কে বললাম 'চলো হে সারথী এখনো অনেক পথ বাকি........'
যেতে যেতে আমরা দর্শন করে নিলাম মাতা ধারী দেবী মন্দির। ইনিই চারধামের রক্ষাকর্তা মাতারানী। এই দেবীর মাহাত্ম কথা বিরাট। সেই গল্প আবার অন্য কোথাও বলবোখন। দেবীর দর্শন করে আশীর্বাদ পাথেয় করে আমরা আবার এগিয়ে চললাম কেদারের পথ ধরে অলকানন্দার পাশে হু হু করে। ....
বেলা ৩টা নাগাদ পৌঁছালাম রুদ্রপ্রয়াগ। রুদ্রপ্রয়াগ হিন্দু ধর্মের আরো একটি প্রয়াগ সঙ্গম যেখানে মন্দাকিনী নদী মিলিত হচ্ছে অলকানন্দার মূল স্রোতে। এখানেও কিছুটা সময় কাটালাম একসাথে দুজনে। আর অনুভব করলাম আমাদের জীবন আর নদীর সঙ্গম কতটা অতুলনীয়।
আবারও এগিয়ে চলা , নদীর থেকে শিখছি কিভাবে বয়ে পথ চলাটাই জীবন আর থেমে যাওয়াটাই বিশ্রাম। পাশে নিচে খরস্রোতা নদী আর দুপাশে নড়বড়ে পাহাড়ের দেওয়াল। ভরা বর্ষায় থমথমে চতুর্দিক যেন এই প্রলয় নামবে।
যেতে যেতে পথের দুপাশে নাম না জানা কত উটকো ঝর্ণাধারা। বর্ষার পাহাড়ে এই একটা বোনাস যে যত্রতত্র ঝর্ণা, ননয়াভিরাম দৃশ্য। জানালা দিয়ে শুধু উপভোগ করে যায় আর প্রার্থনা করে যাওয়াটাই যেন বেঁচে ফেরার উপায়। এইভাবে দুরুদুরু পথ চলতে চলতে বিকেলে পোছালাম সোনপ্রয়াগ। আরও একটি প্রয়াগ , যেখানে বাসুকি নদী মিলিত হচ্ছে মন্দাকিনী নদীর সাথে। কেদারনাথ যাত্রার শুরু এই সোনপ্রয়াগ থেকেই। তাই এই শ্রাবনের রবিবার বিকেলে এখানের ভীড় চোখে পড়ার মতো। ভারতের কোনা কোনা থেকে আসা ভোলে ভক্তরা বাবা কেদার নাথের যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমাদের গন্তব্যে সোনপ্রয়াগ থেকে আরো ১০ কিলোমিটার উপরে ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দির। খুবই চড়াই খারাপ রাস্তা এখানে। যেকোনো মুহূর্তেই একটা বড়ো বিপদ ঘটে যাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার এখানে। মেঘে ঢাকা চারিদিক। কিছুটি দেখা যাচ্ছে না কোনো রকমে থ্রিল ড্রাইভ করে পৌঁছালাম সন্ধ্যায় ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামে। গতকাল রাত ১ টা থেকে যাত্রা শুরু করে আজ রবিবার সন্ধ্যায় পোঁছালাম। প্রায় ১৮ ঘন্টার পথ। দুরুত্ব প্রায় ৫০০ কিমি।
আগে থেকেই বুকিং করা ছিল উত্তরাখণ্ড সরকারের একটি উদ্যোগ, গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম লিমিটেড (GMVN), বলা বাহুল্য এখানে থাকার এটাই সবথেকে বেস্ট স্টে।
https://gmvnonline.com/room-tariff.php?trhID=43
সারাদিনের ধকল সামলে রাতের খাওয়া সেরে সুন্দর সাজানো গোছানো এই মনোরম পরিবেশে আমরা মগ্ন হলাম দুজনা। পাঁচ বছর আগের সেই মুহূর্ত গুলো আসতে আস্তে ভেসে উঠছে মনের পর্দায় আর ভালোবাসা ঘনীভূত হচ্ছে প্রকৃতির আপন মহিমায়। আগামীকাল সেই স্বর্ণিল মুহুর্ত্বগুলো বাস্তবে রূপ নেবে আরো একবার , নতুন করে আবার প্রেমে পড়বো তোমার। তুমি আমার আমি তোমার।